অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের দরুন এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বড়ো ধাক্কা খেয়েছে। নরেন্দ্র মোদি দলকে জেতানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া মানে এই নয় যে নিচুতলার নেতা-কর্মীরা গা ছাড়া দেবেন। মোদিজি চারশো পারের ডাক দেওয়ায় তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, জয় সহজে চলে আসবে। চারশো না হোক, সাড়ে তিনশো তো আসবেই। তাই তাঁদের জনসংযোগে ভাটা পড়ে গিয়েছিল। অনেক জায়গায় সংগঠন জোরালো ছিল না। আর তার ফলে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বত্রিশ আসন দূরে থাকল। এনডিএ তিনশোর আগেই থেমে গেল।
এবারের নির্বাচনে সব জায়গায় যে এক ফল হয়েছে, তা কিন্তু নয়। মোদি ম্যাজিক কাজে লেগেছে ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, কেরল, দিল্লি, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু বড়ো অঘটন ঘটে গিয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতে। প্রথমেই উত্তরপ্রদেশের কথা বলতে হয়। কারণ এই রাজ্যে তারা গতবারের তুলনায় উনত্রিশটি আসন এবার কম পেয়েছে। এখানে নিচুতলার নেতা-কর্মীদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সাংগঠনিক দিক থেকে ঢিলে দিয়েছিল। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ওপর ভরসা করে গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকী ভোট করানোর দিকেও তেমন নজর দেননি। যার দরুন এবার এই রাজ্যে ভোটের হার বেশ কম ছিল। পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস বিজেপিকে বিপাকে ফেলেছিল। আর ভোটের সময় মস্ত বড়ো ভুল করেছিলেন ফৈজাবাদ (যেখানে অযোধ্যা অবস্থিত) কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী লালু সিং। ক্ষমতার দম্ভে তিনি সংরক্ষণের কথা বলতে গিয়ে সংবিধান পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার কথা বলেছিলেন। কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি-সহ বিরোধী নেতারা সংবিধান পরিবর্তনের কথাটাকেই নেতিবাচক হিসাবে ব্যবহার করে দলিত, পিছড়ে বর্গকে খেপিয়ে দেন বিজেপির বিরুদ্ধে। মোদি তা মেরামতের চেষ্টা করলেও এবং স্বয়ং লালু সিং মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছে বললেও যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। যে রামমন্দির আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশে বিজেপির উত্থান, সেই মন্দির উদ্বোধনের পরও লালু সিং পরাস্ত হলেন খোদ অযোধ্যাভূমিতে। হিন্দুত্ব তথা রামমন্দির কোনও দাগ কাটেনি। এটা বিজেপির পক্ষে ভীষণ চিন্তার বিষয়। অযোধ্যানগরী নতুন করে গড়ে তোলার সময় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পাওয়াটাও এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ। তবে সবচেয়ে বড়ো কারণ জাতপাতের অঙ্কে বিরোধীদের এগিয়ে যাওয়াটা। তাই শুধু ফৈজাবাদ নয়, গোটা উত্তরপ্রদেশেই ভীষণ ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। দলিত, পিছড়ে বর্গের দল হিসাবে পরিচিত বিএসপির ঝুলি পর্যন্ত শূন্য। তাদের ভোট সমাজবাদী পার্টি টেনে নিয়েছে।
মহারাষ্ট্রে বিজেপির সর্বগ্রাসী খেলা সেখানকার মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। শিবসেনা ভাঙার পর দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অজিত পাওয়ারকে দিয়ে এনসিপি ভাঙানো তো নয়ই। ফলে বিজেপি গতবারের তুলনায় তেরোটি আসন কম পেয়েছে। এনসিপি (অজিত) পেয়েছে মাত্র একটি আসন। কিন্তু এনসিপি (শরদ) পেয়েছে সাতটি আসন। আর শিবসেনা (শিন্দে)-র তুলনায় শিবসেনা (উদ্ধব) দু’টি আসন বেশি পেয়েছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস এক থেকে বেড়ে হয়েছে তেরো।
মাসকয়েক আগে মাত্র বিজেপি রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করলেও তার রেশ ধরে রাখতে পারেনি লোকসভা নির্বাচনে। গতবার তারা যেখানে চব্বিশটি আসনে জিতেছিল, সেখানে এবার তারা পেয়েছে মাত্র চোদ্দটি। কেন দশটি কম পেল, তা নিশ্চয় বিজেপি খতিয়ে দেখবে। তাহলে কি রাজস্থানের বিজেপি সরকারের প্রত্যাশা পূরণে খামতি রয়েছে? হরিয়ানাতে বিজেপির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এবার তারা পাঁচটি আসন কম পেয়েছে। গতবার দশটি আসন পেয়েছিল। কৃষক আন্দোলনের প্রভাব পড়তেই পারে। পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন কেলেঙ্কারি, কয়লা ও গোরু পাচার মামলায় তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের জেলে যাওয়া এবং সন্দেশখালিকাণ্ড বিজেপিকে বড়ো হাতিয়ার তুলে দিলেও কাজে দেয়নি মূলত সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং প্রার্থী নির্বাচন ও নাম ঘোষণায় অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গেই বিজেপি সবচেয়ে ভালো ফল করবে। কিন্তু বাস্তবে তারা গতবারের তুলনায় ছ’টি আসন কম পেল মূলত ভেট না করাতে পেরে। সেজন্য যে সক্রিয় সংগঠন দরকার, তা তাদের ছিল না। মানুষ যে তাদের দিকে ঝুঁকেছিল, তা জনসভা, রোড শো-তে জনজোয়ার দেখে বোঝা গিয়েছিল। এসব থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে বিজেপিকে ভবিষ্যতেও পস্তাতে হতে পারে।