আসানসোল (প্রেম শঙ্কর চৌবে): ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক দুর্নীতির পর্দাফাঁস ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। নারদ, সারদা, শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি, পৌর নিয়োগ দুর্নীতি, গরু ও কয়লা পাচারের পর এখন সামনে এসেছে বালু পাচারের নতুন কেলেঙ্কারি। গত দেড় মাসে ইডি (Enforcement Directorate) রাজ্যে দু’বার ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েছে। এবার তাদের তদন্তের আওতায় এসেছে আসানসোল শিল্পাঞ্চল (Shilpanchal)।
💣 দশকের পর দশক ধরে শিল্পাঞ্চলের সুনাম গিলে খাচ্ছে চোরাচালান
আসানসোলের শিল্পাঞ্চল গত চার থেকে পাঁচ দশক ধরে পাচারের শিকার। কয়লা, লোহা, অস্ত্র, গরু, মাদক থেকে শুরু করে বালু—সব ক্ষেত্রেই এই অঞ্চল যেন মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য।
চোরাচালান চলে সংগঠিত ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—তারা জানে না, না কি চোখ বুজে আছে?

🌊 দমোদর-অজয়: বিপন্ন দুই পুরুষ নদী
দমোদর ও অজয়—এই দুই নদী আসানসোলকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ তাদের বুকে চলছে বালু তোলার নামে প্রকৃতির খুন।
অতি মুনাফার নেশায় মাফিয়ারা নদীর গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে, গভীর গর্ত খুঁড়ে জলপ্রবাহ রুদ্ধ করছে। যদি একদিন এই দুই নদী পথ বদলে ফেলে, তার ক্ষতি পূরণ অসম্ভব হবে।

🚜 হাই-টেক পাচার: রাতের অন্ধকার নয়, এখন দিনের আলোয় চলছে বাণিজ্য
আগে পাচারকারীরা রাতের অন্ধকারে ট্রাক ভর্তি বালু নিয়ে যেত। এখন তারা দুপুরবেলায় প্রশাসনের চোখের সামনেই বালু তোলার সাহস দেখাচ্ছে।
অনুমোদন থাকে ১০ ট্রাক বালু তোলার, অথচ প্রতিদিন ২০০-২৫০ ট্রাক বালু তোলা হচ্ছে। এক ট্রাকের নম্বর ব্যবহার করে একাধিক ট্রাক চালানো, ফেক ই-চালান, ওভারলোডিং, এমনকি সরকারি অনুমোদিত ঘাটের বাইরে বালু তোলা—সবই চলছে প্রকাশ্যে।
🏗️ ‘ড্রেজিং’-এর নামে মৃত্যু ফাঁদ

সরকারি ভাষায় ড্রেজিং, বাস্তবে সেটা বালু পাচারের মুখোশ। নদীর গা ঘেঁষে বিপজ্জনক গর্ত তৈরি হচ্ছে, যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষ ডুবে মরছে। গত কয়েক বছরে দমোদর-অজয়ে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অথচ প্রশাসনের কোনো হেলদোল নেই।
💰 অশিক্ষিত মাফিয়ার বিলাস জীবন, শিক্ষিত সমাজ বেকার
বালু পাচার থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এই টাকার জোরে এক শ্রেণির মানুষ রাজার মতো জীবন কাটাচ্ছে—বাড়ি, গাড়ি, বিলাসিতা—সবই আছে।
অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণেরা চাকরির অভাবে হতাশ। ফলে অসাম্য ও ক্ষোভ বাড়ছে শিল্পাঞ্চলে। স্থানীয় রাজনীতির ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।
🚨 ইডির হানা: দমরা-তিরাটে চাঞ্চল্যকর দৃশ্য

বৃহস্পতিবার সকালে ইডির দল আসানসোলের বালু ব্যবসায়ী মনীশ বাগাড়িয়ার দফতরে অভিযান চালায়। কিন্তু একই সময়ে দেখা যায়, দমরা ও তিরাট ঘাটে অবাধে বালু তোলা চলছে!
দমরায় এক পাচারকারী “পাপ্পু”-র ঘাটে ৫০ থেকে ১০০ ট্রাক অবৈধ বালু মজুত ছিল। তিরাট ঘাটে রাতভর ১৫০-২০০ ট্রাক বালু তোলা হয়েছিল।
৬টি বড় JCB মেশিন ও ২০০ ট্রাক প্রস্তুত ছিল নদীর বুক থেকে বালু তুলতে। প্রশাসন? নিশ্চুপ।
⚖️ NGT ও DM-এর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা
ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল (NGT) স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে—বর্ষাকালে কোনো নদী থেকে বালু তোলা যাবে না। পশ্চিম বর্ধমানের জেলা প্রশাসনও ১ জুলাই থেকে বালু তোলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। তবুও চলছে অবাধ পাচার।
প্রশ্ন উঠছে—“জেলার DM-এর নির্দেশ কি আজ অর্থহীন?”
যখন ১১টি ট্রাক ধরা পড়েছিল দমরায়, সবাই ভেবেছিল পুলিশ সচেতন হয়েছে। কিন্তু সেটি প্রমাণিত হয়েছিল দেখানোর অভিযান মাত্র।
🧨 পুলিশ-রাজনীতি-মাফিয়া: এক অদৃশ্য জোট
শিল্পাঞ্চলে এখন দুটি জিনিস সাধারণ মানুষ বুঝে নিয়েছে—
১️⃣ অবৈধতার বিরুদ্ধে মুখ খুললে হামলা অনিবার্য।
২️⃣ ঘুষের জালে প্রশাসনও জড়িয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি পাঞ্জাবি মোড় থানার এক এএসআই ঘুষ কাণ্ডে ধরা পড়ে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশই রাস্তায় ট্রাকচালকদের কাছ থেকে টাকা তোলে।
এখন প্রশ্ন—এই দুষ্টচক্র ভাঙবে কে?
⚠️ শেষ কথা: নদী মরছে, প্রশাসন চুপ, আর রাজনীতি উপভোগ করছে খেলাটি
যে শিল্পাঞ্চল একসময় গর্বের প্রতীক ছিল, আজ তা ধীরে ধীরে দমোদর-অজয়ের মৃতপ্রবাহে ডুবে যাচ্ছে।
ভোটের আগে ইডির অভিযানে নতুন মাত্রা যোগ হলেও, প্রশ্ন একটাই—
👉 “এই অবৈধ বালু সাম্রাজ্য কে রুখবে? প্রশাসন, কেন্দ্র না জনগণ?”