কলকাতা (প্রেম শঙ্কর চৌবে):
ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পাওয়া ‘বন্দে মাতরম’ পূর্ণ করল গৌরবময় ১৫০ বছর। আজ এই উপলক্ষে সংসদের উভয় কক্ষে বিশেষ আলোচনা হবে, যার সূচনা করবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে—যে মানুষটি এই অমর সৃষ্টির জনক, সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কি আজও উপেক্ষিত নন?
১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘বন্দে মাতরম’। পরে ১৮৮২ সালে এটি স্থান পায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগান্তকারী উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটির সুরারোপ করেন। ১৮৯৬ সালে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথমবার প্রকাশ্যে গাওয়া হয় বন্দে মাতরম। আর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই গানই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেরণামন্ত্র।

আনন্দমঠ ও মাতৃভূমির ত্রিরূপ
‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মাতৃভূমিকে তিন রূপে দেখানো হয়েছে—অতীতের গৌরবময় মা, বর্তমানের জরাজীর্ণ মা এবং ভবিষ্যতের পুনর্জাগরিত মা। ঋষি অরবিন্দ লিখেছিলেন, এই মা ভিক্ষার থালা হাতে নয়—এই মা সত্তর কোটি হাতে তরবারি তুলে ধরেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র: নবজাগরণের অগ্রদূত
১৮৩৮ সালে জন্ম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দেবী চৌধুরাণী’-র মতো সাহিত্যকীর্তির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির আত্মসম্মান ও জাতীয়তাবোধকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ‘বন্দে মাতরম’-এর মাধ্যমে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আধ্যাত্মিক ভিত্তি গড়ে দেন।

বিপ্লবীদের মুখে মুখে বন্দে মাতরম
স্বদেশি আন্দোলনের সময় এই গান ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধঘোষ। জার্মানির স্টুটগার্টে ১৯০৭ সালে ভিকাজি কামা যে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, তাতে লেখা ছিল ‘বন্দে মাতরম’। শহিদ মদনলাল ধিংরার মৃত্যুর আগে শেষ উচ্চারণও ছিল বন্দে মাতরম। বিদেশে থাকা ভারতীয়দের কাছেও এটি ছিল মুক্তির প্রতীক।
জাতীয় গানের স্বীকৃতি
১৯৫০ সালে সংবিধান সভা সর্বসম্মতভাবে বন্দে মাতরমকে জাতীয় গানের স্বীকৃতি দেয়। রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ জানিয়েছিলেন, এই গানের মর্যাদা জাতীয় সংগীত ‘জন গণ মন’-এর সমান।
দেশজুড়ে ১৫০ বছরের উদযাপন
এ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সারা দেশেই বন্দে মাতরমের ১৫০ বছর উদযাপিত হচ্ছে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়ামে হয়েছে জাতীয় স্তরের অনুষ্ঠান। ডাকটিকিট, স্মারক মুদ্রা, প্রদর্শনী, দেওয়ালচিত্র, বৃক্ষরোপণ—সবকিছুর মধ্য দিয়েই নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমের বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু বাংলায় কি ভুলে যাওয়া হল বঙ্কিমচন্দ্রকে?
কলকাতার ৫ নম্বর প্রতাপচট্টোপাধ্যায় স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি আজ কার্যত ধ্বংসপ্রায়। ২০০৬ সালে এই বাড়িতে ‘সাহিত্য সম্রাট স্মৃতি গ্রন্থাগার’ চালু হলেও আজ সেখানে অযত্ন, অপরিচ্ছন্নতা আর অব্যবস্থার চিত্র স্পষ্ট।

বঙ্কিমচন্দ্রের পঞ্চম প্রজন্মের উত্তরপুরুষ সজল চট্টোপাধ্যায় ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,
“রাষ্ট্র যাঁর জন্য বন্দে মাতরম পেয়েছে, আজ তাঁর উত্তরাধিকারীদেরই কেউ চেনে না। মুখ্যমন্ত্রীও কোনো দিন আমাদের খোঁজ নেননি।”

জোরালো দাবি: বঙ্কিম বিশ্ববিদ্যালয় চাই
আজ বিদ্যাসাগরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু দেশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্রের নামে কেন নেই? এই প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্রভাবে উঠছে। দেশজুড়ে রবীন্দ্র ভবনের মতো বঙ্কিম ভবন নির্মাণ ও ‘বঙ্কিম বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের দাবিও জোরদার হচ্ছে।
বন্দে মাতরম আজ শুধু একটি গান নয়—এটি জাতির আত্মা। কিন্তু সেই আত্মার স্রষ্টা কি আজও অবহেলিতই রয়ে যাবেন?












